পবিত্র কোরআন সংকলন ও সংরক্ষণের ইতিহাস
"আল কোরআন বিশ্বের বিস্ময়কর গ্রন্থ। এটি সর্বাধিক প্রশংসিত মহা প্রজ্ঞাময় রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ নবী বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতারিত হয়েছে। বিশ্বজনীন এ গ্রন্থের আবেদন ও উপযোগিতা সব যুগে এবং সব স্থানেই কার্যকর রয়েছে। কোরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এ গ্রন্থ দুইবার নাজিল হয়েছে। প্রথমে একবার পুরো কোরআনের আয়াত প্রথম আসমানে 'বাইতুল ইজ্জতে' নাজিল হয়েছে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩ বছর ধরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ঘটনা উপলক্ষে, যুগ-জিজ্ঞাসার জবাবে নাজিল হয়েছে। কুদরতি নিয়মে হাজারো বছর ধরে অত্যন্ত বিস্ময়কর প্রক্রিয়ায় এ গ্রন্থকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লিখে রাখার পাশাপাশি হাজারো বছর ধরে হৃদয় থেকে হৃদয়ে একে ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোরআনের লাখো হাফেজ বা মুখস্থকারী রয়েছেন। মানব ইতিহাসে আর কোনো গ্রন্থের এত হাফেজ নেই। রাসুল (সা.)-এর যুগে কোরআন সংরক্ষণ : যেহেতু পূর্ণ কোরআন একসঙ্গে নাজিল হয়নি; বরং কোরআনের বিভিন্ন আয়াত বিশেষ প্রয়োজনীয়তা ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে; তাই রাসুল (সা.)-এর যুগে শুরু থেকেই বই আকারে একে সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। আসমানি গ্রন্থগুলোর মধ্যে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনকে এ বিশেষত্ব দান করেছেন যে কলম-কাগজের চেয়েও একে অগণিতসংখ্যক হাফেজের স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করেছেন। মুসলিম শরিফে এসেছে, আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-কে বলেছেন, 'আমি আপনার ওপর এমন কিতাব অবতীর্ণ করব, যাকে পানি ধুয়ে নিতে পারবে না। ' অর্থাৎ দুনিয়ার সাধারণ গ্রন্থগুলোর অবস্থা এই যে পার্থিব বিপর্যয়ের কারণে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়; কিন্তু কোরআনকে মানুষের অন্তরে অন্তরে এভাবে সংরক্ষণ করা হবে যে তা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কাই থাকবে না। তাই প্রথম দিকে লেখার চেয়েও কোরআন মুখস্থ করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই সাহাবায়ে কেরামের একটি বড় অংশ হাফেজে কোরআন হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন-হজরত আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, তালহা, সাআদ, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হুজায়ফা বিন ইয়ামান, হজরত সালেম, আবু হুরায়রা, ইবনে ওমর, ইবনে আব্বাস, আমর ইবনুল আস, আবদুল্লাহ বিন আমর, মুয়াবিয়া, ইবনে জুবাইর, আবদুল্লাহ বিন আস্ সায়েব, আয়েশা, হাফসা, উম্মে সালমা, উম্মে ওয়ারাকা, উবাই ইবনে কাআব, মাআজ ইবনে জাবাল, আবু হুলাইমা মাআজ, জায়েদ ইবনে সাবেত, আবুদ্ দারদা, মুজাম্মা বিন জারিয়া, মাসলামা বিন মুখাল্লিদ, আনাস ইবনে মালেক, উকবা বিন আমের, তামিম দারেমি, আবু মুসা আশআরি এবং হজরত আবু জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ অন্যতম হাফেজ সাহাবি ছিলেন। (আল-ইত্বকান, খ. ১, পৃ. ৭৩-৭৪) মূলত উল্লিখিত নামগুলো সেসব সাহাবির, যাঁদের নাম হাফেজে কোরআন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। অন্যথায় আরো অগণিত সাহাবির গোটা কোরআন মুখস্থ ছিল। কেননা বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) কখনো কখনো একেক গোত্রে সত্তরজন করে কোরআনের শিক্ষক পাঠাতেন। বিরে মউনার যুদ্ধে সত্তরজন কারি সাহাবি শহীদ হওয়ার কথা বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। হাফেজ সাহাবির সংখ্যা এতই বেশি যে ইমামার যুদ্ধে প্রায় সমসংখ্যক হাফেজ, আরেক বর্ণনা মতে, পাঁচ শ (ইবনে কাছির, খ. ১, পৃ. ২৬), অন্য বর্ণনা মতে, সাত শ কারি/হাফেজ সাহাবি শহীদ হয়েছেন। (উলুমুল কোরআন, পৃ. ১৭৬) রাসুল (সা.)-এর যুগে কোরআন সংকলন : আরবদের দুনিয়াজুড়ে খ্যাত বিস্ময়কর স্মৃতির ওপর ভর করে কোরআন সংরক্ষণের পাশাপাশি রাসুল (সা.) লিখিতভাবে কোরআন সংকলন, সংরক্ষণ ও একত্রীকরণের ব্যবস্থা করে গেছেন। ওহির ইলম লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি চল্লিশজন 'কাতেবে ওহি' বা ওহি লেখক নিযুক্ত করেছেন। সে সময় কাগজ ছাড়াও পাথর, চামড়া, খেজুরের ডাল, বাঁশের টুকরা, গাছের পাতা এবং চতুষ্পদ জন্তুর হাড্ডির ওপর কোরআন লিখে রাখা হতো। এভাবেই রাসুল (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে কোরআনের একটি কপি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, যদিও তা পুস্তিকারূপে ও গ্রন্থিত আকারে ছিল না। এ ছাড়া সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো কাছে ব্যক্তিগতভাবে কোরআনের সম্পূর্ণ অথবা অসম্পূর্ণ কপি বিদ্যমান ছিল। যেমনটা বুখারি শরিফের এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, 'রাসুল (সা.) কোরআন নিয়ে (অর্থাৎ কোরআনের কপি নিয়ে) শত্রুদের ভূখণ্ডে সফর করতে নিষেধ করেছেন।' (বুখারি শরিফ, খ. ১, পৃ. ৪১৯) আবু বকর (রা.)-এর যুগে কোরআন সংকলন : যেহেতু রাসুল (সা.)-এর যুগে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন বস্তুর ওপর কোরআন সংরক্ষিত ছিল, তাই হজরত আবু বকর (রা.) নিজ খেলাফতের সময় বিক্ষিপ্ত অংশগুলো একত্র করে সংরক্ষণের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে সহিহ বুখারি শরিফে। হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা) বলেন, ''ইমামার যুদ্ধের পরপরই হজরত আবু বকর (রা.) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি সেখানে গিয়ে দেখি ওমর (রা.)ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আবু বকর (রা.) আমাকে বললেন-ওমর (রা.) এসে আমাকে বলেছেন, 'ইমামার যুদ্ধে কোরআনে হাফেজদের একটি বড় অংশ শহীদ হয়ে গেছে। আর এভাবেই যদি বিভিন্ন স্থানে কোরআনের হাফেজরা শহীদ হতে থাকেন, তাহলে আমার আশঙ্কা হয়, কোরআনের একটি বড় অংশ হারিয়ে যাবে। তাই আমার অভিমত হলো, আপনি চাইলে কোরআন সংকলনের নির্দেশ দিতে পারেন।' আমি তাঁকে বললাম, 'যে কাজ রাসুল (সা.) করেননি, সেই কাজ আমি কিভাবে করব?' জবাবে ওমর (রা.) বললেন, 'আল্লাহর কসম, এ কাজ উত্তমই উত্তম। এরপর ওমর (রা.) বারবার আমাকে একই কথা বলতে লাগলেন। একপর্যায়ে এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা আমার অন্তর খুলে দিলেন। এখন ওমরের অভিমত যা, আমার অভিমতও তা-ই।' এরপর আবু বকর (রা.) আমাকে বললেন, 'তুমি বিচক্ষণ যুবক, তোমার ব্যাপারে আমাদের কোনো খারাপ ধারণা নেই। রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তুমি ওহি লেখার কাজ করতে। তাই তুমিই কোরআনের আয়াতগুলো অনুসন্ধান করে সেগুলো একত্র করো।' জায়েদ (রা.) বলেন, 'আল্লাহর কসম, তাঁরা যদি আমাকে সস্থান থেকে কোনো পাহাড় সরানোর আদেশ দিতেন, তাহলে তা আমার কাছে এত কঠিন মনে হতো না, যতটা কঠিন মনে হয়েছে কোরআন সংকলনের দায়িত্ব পালনের নির্দেশটি।' আমি বললাম, 'আপনারা এমন কাজ কিভাবে করবেন, যা রাসুল (সা.) করেননি?' আবু বকর (রা.) বললেন, 'আল্লাহর কসম, এ কাজে মঙ্গলই মঙ্গল রয়েছে। এরপর তিনি আমাকে বারবার তা বলতে লাগলেন। একপর্যায়ে এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা আমার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিলেন, যে বিষয়ে বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন হজরত আবু বকর ও ওমর (রা.)-কে। অতঃপর আমি কোরআনের আয়াত অনুসন্ধান করতে লাগলাম। সুতরাং কোরআনের আয়াতগুলো খেজুরের ডাল, পাথরের তখতি এবং মানুষের হৃদয় থেকে খুঁজে খুঁজে আমি তা একত্র করলাম। সুরা তওবার শেষ আয়াত আবু খুজাইমা আনসারি (রা.)-এর কাছে পেলাম, অন্যদের কাছে (লিখিতভাবে) তা আমি পাইনি'।"" (বুখারি শরিফ, হা. ৪৯৮৬; ইবনে কাছির : ভূমিকা) তবে নিঃসন্দেহে সে আয়াতটি হাফেজ সাহাবিদের মুখস্থ ছিল এবং সেটি 'মুতাওয়াতির' বর্ণনা দ্বারাও কোরআনের আয়াত হওয়া প্রমাণিত। (উলুমুল কোরআন, তকি্ব উসমানি, পৃ. ১৮৫) জায়েদ (রা.)-এর গবেষণা পদ্ধতি : হজরত জায়েদ (রা.) নিজে কোরআনে হাফেজ হওয়া সত্ত্বেও এককভাবে কোরআন সংকলনের গুরুদায়িত্বটি আঞ্জাম দেননি, বরং তিনি চারটি পদ্ধতিতে কোরআন সংকলন করতেন। এক. কোনো আয়াত পাওয়া গেলে সর্বপ্রথম তা নিজের হিফজ ও মুখস্থের সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন। দুই. হজরত উমর (রা.)ও হাফেজ ছিলেন। বর্ণিত আছে যে তিনিও আবু বকর (রা.)-এর নির্দেশে জায়েদ (রা.)-কে সহযোগিতা করতেন। তিন. কোনো আয়াত ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করা হতো না যতক্ষণ না দুজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি এ কথার সাক্ষ্য দিতেন যে এ আয়াত রাসুল (সা.)-এর সামনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে অথবা সেগুলো রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর আগে তাঁর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুরা তাওবার শেষ আয়াতটি যখন কেবল হজরত আবু খুজাইমা (রা)-এর কাছে পাওয়া গেছে তখন এ সূত্রে সেটিকে গ্রহণ করা হয়েছে যে জীবদ্দশায় রাসুল (সা.) সে সাহাবির একজনের সাক্ষ্যকে দুজনের সাক্ষ্যের সমতুল্য ঘোষণা করে গেছেন। চার. অবশেষে চূড়ান্ত পর্যায়ে সে আয়াতগুলোর সমষ্টিকে বিভিন্ন সাহাবির ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত কোরআনের পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হতো। আবু বকর (রা.) সংকলিত কোরআনের বৈশিষ্ট্য : আবু বকর (রা.) সংকলিত কোরআনকে পরিভাষায় 'উম্ম' বা আদি কোরআন বলা হয়। কেননা এটিই প্রথম লিখিত সুবিন্যস্ত কোরআন। এর বৈশিষ্ট্য হলো-এটি রাসুল (সা.) বর্ণিত ধারাক্রম অনুসারে প্রস্তুত করা হয়েছে। সুরাগুলো আলাদা রেখে দেওয়া হয়েছে; সুরার ক্রমধারা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। এটি সাত হরফ বা সাত কেরাতে লেখা হয়েছে। এ কপিটি হীরার হস্তাক্ষরে লেখা হয়েছে। এখানে কেবল সেসব আয়াত লেখা হয়েছে, যেগুলোর তিলাওয়াত রহিত হয়নি। এই সংকলনের উদ্দেশ্য ছিল একটি সুবিন্যস্ত, গ্রন্থিত কোরআনের কপি সংগ্রহ করা, যাতে প্রয়োজনের সময় এর দ্বারস্থ হওয়া যায়। এটি ১৩ হিজরিতে শুরু হয়ে পূর্ণ এক বছর মতান্তরে প্রায় দুই বছরে সমাপ্ত হয়। (তারিখুল কোরআনিল কারিম, তাহের আল কুরদি; খ. ১, পৃ. ২৮) হজরত আবু বকর (রা.) সংকলিত কোরআনটি মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিল। এরপর উমর (রা.)-এর কাছে। তাঁর শাহাদাতের পর নিজ অসিয়ত মোতাবেক রাসুল (সা.)-এর স্ত্রী, নিজ কন্যা হাফসা (রা.)-এর কাছে বিদ্যমান ছিল। অতঃপর মারওয়ান বিন হাকাম তাঁর রাজত্বকালে এ কপিটি চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। হাফসা (রা.)-এর ইন্তেকালের পর মারওয়ান এ কপি হজরত ইবনে উমর (রা.)-এর কাছ থেকে নিয়ে যান। অতঃপর তিনি এ চিন্তা করে সেটি জ্বালিয়ে দিয়েছেন যে উসমান (রা.)-এর খেলাফত আমলে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তুতকৃত কপির সঙ্গে এর কেরাতের পার্থক্যের কারণে অদূর ভবিষ্যতে ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কেননা উসমান (রা.) সাত কেরাতের পরিবর্তে এক কেরাত, আঞ্চলিক একাধিক ভাষার পরিবর্তে প্রমিত এক ভাষায় সে কোরআনটি সংকলন করেছেন। (উলুমুল কোরআন, তকি্ব উসমানি, পৃ. ১৮৬-১৮৭)"
কোরআন যেভাবে সংরক্ষিত হয়েছে
"অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সব ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিকৃতি থেকে আল্লাহ কোরআনুল কারিমকে সংরক্ষণ করেছেন। আর এটা মহান আল্লাহর অঙ্গীকারও বটে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমিই কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই তা সংরক্ষণ করব।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯) পবিত্র কোরআনের সংরক্ষণ পদ্ধতি মানবজাতির জন্য এক মহাবিস্ময়। কেননা আল্লাহ তাআলা কোরআনকে মুখস্থকরণ, লিপিবদ্ধকরণ ও মানুষের আমলে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছেন। তিনি তা সংরক্ষণ করেছেন তার শব্দ, বাক্য, পাঠপদ্ধতি, অর্থ, মর্ম, ব্যাখ্যা, আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত সব কিছুই সংরক্ষণ করেছেন। ফলে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর প্রায় দেড় হাজার বছর গত হলেও কোরআনের এক হরফ ও নুকতা পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়নি। কোরআনের চ্যালেঞ্জ পবিত্র কোরআনের নির্ভরযোগ্যতা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে কোরআনের একাধিক জায়গায় আল্লাহ মানবজাতির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এটা সেই কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোনো সুরা আনয়ন করো এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সব সাহায্যকারীকে আহ্বান করো। যদি তোমরা আনয়ন না করো এবং তোমরা কখনোই তা করতে পারবে না, তবে সেই আগুনকে ভয় করো, মানুষ ও পাথর যার ইন্ধন হবে। অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩-২৪) যেভাবে সংরক্ষিত হয়েছে কোরআন আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের ছয়টি জিনিস সংরক্ষণের মাধ্যমে কোরআনুল কারিমকে সংরক্ষণ করেছেন। তা হলো— ১. কোরআনের শব্দ-বাক্য : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর যে শব্দ ও বাক্যে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল, আল্লাহ ঠিক সেই শব্দ-বাক্যে কোরআন সংরক্ষণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়ই তা তাঁর হূদয়ে প্রোথিত হয়ে যেত। এরপর তিনি ওহি লেখক কোনো সাহাবিকে ডেকে তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। অতঃপর সাহাবিরা তা মুখস্থ করে ফেলতেন। তবে কোরআনুল কারিম ‘মাসহাফ’ তথা গ্রন্থের রূপ লাভ করে উসমান (রা.)-এর যুগে। ২. কোরআনের অর্থ ও মর্ম : কোরআনের শব্দ-বাক্যের মতো কোরআনের অর্থ ও মর্মও আল্লাহ সংরক্ষণ করেছেন। কেননা অর্থ ও মর্ম সংরক্ষণ করা না হলে মানুষ কোরআনের ভুল ব্যাখ্যায় লিপ্ত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই কোরআনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৪) মহানবী (সা.)-এর প্রদত্ত কোরআনের ব্যাখ্যা হাদিসে সংরক্ষিত আছে এবং সেগুলোই কোরআনের ব্যাখ্যার মূল উৎস ও বিশুদ্ধতা নিরূপণের মাপকাঠি। মূলত এটাও আল্লাহর সংরক্ষণপ্রক্রিয়ার অংশ। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই।’ (সুরা : কিয়ামা, আয়াত : ১৯) ৩. ভাষা সংরক্ষণ : কোরআনের ভাষা তথা আরবি ভাষাকেও আল্লাহ সংরক্ষণ করেছেন। পৃথিবীর বহু ধর্মগ্রন্থের ভাষা বিস্মৃত হয়েছে এবং বহু ভাষা সাধারণ মানুষের চর্চার বাইরে চলে গেছে। যেমন—হিব্রু ও সংস্কৃতি। কিন্তু আল্লাহ কোরআনের ভাষা আরবিকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা দান করেছেন এবং তার পঠন-পাঠন সহজসাধ্য করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কোরআন জগত্গুলোর প্রতিপালকের থেকে অবতীর্ণ। জিবরাইল যা নিয়ে অবতরণ করেছে আপনার অন্তরে, যাতে আপনি সতর্ককারী হতে পারেন। অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়।’ (সুরা : শুআরা, আয়াত : ১৯২-১৯৫) ৪. আমল : আল্লাহ মুমিনের আমলের মাধ্যমেও কোরআনের প্রায়োগিক রূপও সংরক্ষণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন কোরআনের বিধানের প্রথম বাস্তবায়নকারী। তিনি তাঁর কথা ও শিক্ষা, আচার-আচরণ ও দৈনন্দিন জীবনের মাধ্যমে উম্মতকে কোরআনের প্রায়োগিক শিক্ষা দান করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় করো যেভাবে আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০০৮) আর এ জন্যই আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.)-এর চরিত্র ছিল কোরআন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৬০১) ৫. কোরআনে নবীর জীবনচরিত্র সংরক্ষণ : মহান আল্লাহ শুধু কোরআন সংরক্ষণ করেননি, বরং যে মহিমান্বিত নবীর ওপর কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর জীবনীও সংরক্ষণ করেছেন। সংরক্ষণ করেছেন তাঁর বংশধারা, পারিবারিক ইতিহাস এবং তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতি অধ্যায়; যেন পৃথিবীর কোনো মানুষ তাঁর চরিত্রে কালিমা লেপন করতে না পারে এবং তাঁর প্রচারিত কোরআনের ব্যাপারে কোনো সংশয় পোষণ করতে না পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি।’ (সুরা : আশ-শরাহ, আয়াত : ৪) ৬. কোরআনের বাহকদের জীবনী সংরক্ষণ : মহানবী (সা.)-এর সাহাবিদের থেকে পরবর্তী যুগে মনীষীদের মধ্যে যাঁরা কোরআনের বাহক ছিলেন, যাঁরা দ্বিনি ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন, মুসলিম মনীষীরা তাঁদের জীবন ও ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন। বিশেষত কোরআনের কোনো ব্যাখ্যাকার ও হাদিসবিশারদকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে তাঁরা অবশ্যই তাঁদের সততা, আল্লাহভীতি ও মেধা-প্রতিভাকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় জাতিগুলোর মধ্যে মুসলিমরাই ‘আসমাউর রিজাল’ নামক এক অনন্য শাস্ত্রের উদ্ভব করেছেন। বিশেষত রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সরাসরি কোরআনের শিক্ষা লাভ করে যাঁরা পুরো পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাসুলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে আল্লাহভীতির জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৩) আল্লাহ সবাইকে কোরআনের প্রতি যথাযথভাবে ঈমান আনার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা"